Socialize

দ্বিতীয় বিয়ে পর্বঃ ৩

গল্পঃদ্বিতীয় বিয়ে
পর্বঃ৩
আবিরের নাম্বারে রিং হচ্ছে,আবির বারবার কেটে দিচ্ছে...
চার,পাঁচবার এমন কল দেওয়ার পর দেখি ফোনটা বন্ধ করে দিলো আবির..আমার ভীষণ দুশ্চিন্তা হতে শুরু করলো সাথে সাথে.কি হচ্ছে..?
আবির কোথায় আছে??ও তো কখনো এমন করে না...........
আমি কাঁপা হাতে টেক্সট পাঠালাম
"তুমি যেখানেই থাকো,এখনি বাসায় চলে আসো.."
ফোন হাতে নিয়ে বসেই থাকলাম আমি...
আবিরের ফোন আসলো না..সময় যত গড়াচ্ছে আমার দুশ্চিন্তা বাড়ছে...আমি আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা না করে তড়িঘড়ি করে দরজাটা খুলে মাথায় ঘোমটা দিতে দিতে আব্বার কাছে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম--
"আব্বা..আপনার ছেলের ফোন বন্ধ আসছে অনেক ক্ষণ ধরে..ওর ফোন তো কখনোই বন্ধ থাকে না..আপনি একটু দেখেন না আব্বা.."
আব্বা মুহুর্তেই লাফ দিয়ে উঠে উত্তর না দিয়ে ফোন হাতে করে বাড়ির বাইরে চলে গেলো..
আমি বাসার দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকলাম বাইরের দিকে তাকিয়ে..আমার বুকের ভেতর খুব জোরে জোরে ধুকপুক ধুকপুক করছে...এক একটা সময় মনে হচ্ছে আমার ভেতর টুকু ছিঁড়ে বের হয়ে আসছে..আধাঘণ্টা হয়ে গেলো আব্বা এলো না ফিরে..আমি ওখানে দাঁড়িয়েই বারবার আবিরের ফোনে ট্রাই করছি..ফোনটা তখনো বন্ধ..
এতো কষ্টেও পাথর হয়ে থাকা আমার চোখের কোণে এবার বোধ হয় পানি জমতে শুরু করলো..একবার বাইরে একবার ফোনের দিকে তাকাতে তাকাতে চোখ মুখ ঝাপসা হয়ে আসছিলো..হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো..তড়িঘড়ি করে দেখি,আব্বার কল...
আমি এক মুহুর্ত দেরী না করে রিসিভ করেই জিজ্ঞাসা করলাম পাগলের মতন--
"আব্বা,আপনার ছেলেকে পেয়েছেন...?"
আব্বা ভীষণ গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো--
"না রে মা..আবির বাড়ি গিয়েছে কিনা এই শুনতে তোমাকে ফোন করলাম..."
আব্বার কথা শেষ হতে না হতেই আমার চোখের পানি গাল গড়িয়ে পড়লো..আবির কোথায় তাহলে..??আমি বোধ হয় এবার আর নিজেকে ঠেকাতে পারবো না..ফোনটা হাত থেকে পড়ে গেল..
আমার শ্বাশুড়ি এতোক্ষণ এখানে ছিলেন না।তিনি জানতেনও না,কি হচ্ছে এদিকে..
তার হাতে ফোন আর মুখে হাসি নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার অবস্থা দেখে,খুব বেশি না.
একটু অবাক হয়ে আমাকে প্রশ্ন করলেন--
"কি হয়েছে রে,বউ..?"
আমি তো উত্তর দেওয়ার মতন অবস্থায় নেই..
যদিও আমি উনাকে আজ অব্দি মায়ের মতন শ্রদ্ধা করে এসেছি,কিন্তু কিছুক্ষণ আগে থেকে উনার কাছে কিছু বলার মত আশা আমি খুইয়ে দিয়েছি...
চোখের পানি গোপন করতে আমি মাথা নিচু করে,আস্তে আস্তে দেয়াল ধরে উঠে আমার ঘরের দিকে গেলাম...
গিয়েই আমার বিছানার উপর আছড়ে পড়ে কাঁদতে লাগলাম..আবিরের কি হলো,আবির কোথায় গিয়েছে..এসব প্রশ্ন আর অজানা ভয়ে আমার প্রাণটা বোধ হয় যায় যায়..আমি ভালো করে কাঁদতেও পারছি না মনে হচ্ছে..আমি কি করবো,কি করলে সব ঠিক হবে,আমার ক্ষমতা থাকলে এরকম কখনোই হতো না...
আমার মনে হচ্ছে আমার শরীরের সমস্ত শক্তি ফুরিয়ে আসছে..আমি হাঁপসে উঠছি নিজের নিঃশ্বাসের সাথে..আমার মুখ দিয়ে "আবির " নাম টা উচ্চারণ হয়ে কেমন জানি গোঙড়ানির মত আওয়াজ আসছে....
হঠাৎ পেছন থেকে পায়ের আওয়াজ কানে আসলো..আমি চট করে ঘুরে পেছনে তাকালাম..
দেখি আবির এসে দাঁড়িয়েছে..
আমি তড়িৎ গতিতে বিছানা ছেড়ে উঠে আবিরকে জড়িয়ে ধরলাম...
সে কি কান্না ওকে জড়িয়ে ধরে....
জিজ্ঞাসা করতে পারছিলাম না,তুমি কোথায় ছিলে...
শুধুই কাঁদছিলাম..আবিরও চুপ করে আমাকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে..আমার অবস্থা খারাপ হচ্ছে দেখে আবির আমাকে খুব দরদের কণ্ঠে আস্তে আস্তে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলছে--
"সসস..চুপ হয়ে যাও,নীলা..আমি এই তো.."
আমি ওর কথা যেন শুনতে পাচ্ছি না.।
মনে হচ্ছে ওকে এভাবেই ধরে রাখি সারাজীবন..
ধরে রাখার কথা মনে হতেই আমার সব মনে পড়ে গেলো..আমি না এক নিমিষেই কেমন জানি কান্না থামিয়ে দিলাম...কয়েকবার বুক টেনে নিঃশ্বাস নিয়ে
আবিরের বুক থেকে আস্তে আস্তে আমার মাথাটা সরিয়ে নিলাম..হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে আস্তে করে বিছানার উপর বসলাম..ভাঙা গলায় আবিরকে প্রশ্ন করলাম--
"কোথায় ছিলে এতোক্ষণ তুমি..?"
আবির আমার সামনে মেঝেতে বসে পড়লো উত্তর দেওয়ার আগে..বসার পরে উত্তর দিলো--
"আমি ছিলাম তো এক জায়গায়..."
"তোমার ফোন বন্ধ ছিলো কেন..?"
"ইচ্ছে করেই,করেছিলাম...
প্রচণ্ড অভিমান ভরে ওর মুখের দিকে তাকালাম-
" ইচ্ছে করেই এতো বড় শাস্তি দিলে...?"
আবির গলা কঠিন করে বললো--
"তুমি নিজেকে কত বড় শাস্তির মুখে ঠেলে দিচ্ছো,সেটা বোঝাতে চেয়েছিলাম.."
আমি চুপ করে মাথা নামিয়ে ফেললাম..আবির আমার পায়ের কাছে এগিয়ে এসে হাত দুটো ধরে বললো--
"যে মানুষটা জেনে বুঝে কিছুক্ষণ আড়ালে থেকেছে বলে নিজের এই অবস্থা করে ফেলেছো..
সেই মানুষটাকে আরেকজনের করে সারাজীবনের জন্য পর করে,তুমি বাঁচবে কি করে ভেবেছো একবারও....??"
চরম সত্যটাকে আবিরের মুখে শুনে আমি যেন একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম..একবার মনে হলো আবিরের কাছে অবুঝ এক আবদার করে বসি--
"চলো না,আবির..এসব কিছু ছেড়ে, দুজন মিলে অনেক দূরে কোথাও চলে যাই.যেখানে অন্য রকম পৃথিবী থাকবে দুজনার।সেখানে কোন অভিযোগ আর যোগ্যতার বিচার থাকবে না.."
ভাবতেই আমার শ্বাশুড়ি মায়ের ডাক শোনা গেলো--
"আবির,একটু এদিকে আয় তো,বাবা..তোর সীমা মামী একটু তোর সাথে কথা বলবে..."
আমার বুকের ভেতর কে জানি বর্শা নিয়ে একটা ফাল করে দিলো..কারণ সীমা মামীর এক আত্মীয়া আছে,যাকে আমার আগে পছন্দ করা হতো আবিরের বউ হিসাবে..বুঝতে বাকি রইলো না,
আমার মানুষটাকে আমার থেকে দূর করার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে...আমি আমার
মনের কথা মনের মাঝেই দাফন করে দিয়ে একটু কঠিন গলায় উত্তর দিলাম--
"সময় হলে ঠিক পেরে যাবো...
সামনে আছি বলে পারছি না..
দূরে গেলে ঠিকই পারবো..."
উত্তরটা কি যে যন্ত্রণার..কিন্তু আমার গলা একটুও কাঁপলো না...আবির আমার মুখের দিকে অসহায়ের মতন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো..এক বড়সড় নিঃশ্বাস নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করলো একেবারে নরম গলায়---
"মেনে নিলাম তুমি পারবে..একটা বার ভেবেছো,আমি পারবো কিনা...??"
আমি আরো কঠিনভাবে উত্তর দিলাম--
"হুম..নতুন মানুষ তোমার জীবনটাকে পূর্ণতায় ভরিয়ে দিবে..তোমার না পারার কি আছে....?"
কথাটা বলতে না বলতেই আবির আমার হাত ছেড়ে দিলো..আমি সাথে সাথে ওর মুখের দিকে তাকালাম..প্রচণ্ড অন্যরকম লাগছে ওর চেহারা..
খুব কঠিন আর মায়াহীন..আমাকে রেখে উঠে দাঁড়ালো..আর বললো--
"ঠিক আছে..তাই হবে..তোমার আর মায়ের কথাই আমি রাখবো..."
আমার চোখ দিয়ে বোধ হয় পানির শেষ ফোঁটা টা গড়িয়ে পড়লো..ঢোক গিলতে কষ্ট হলো..
পাথরের মত বসে থাকলাম..আবির পাশের ঘরে মায়ের কাছে চলে গেলো...আমার বুকের ভেতর টাও কেমন জানি ফাঁকা লেগে উঠলো..বুঝতে পারলাম এখানে আর থাকাটা আমার দায় হয়ে যাচ্ছে..আবির তো রাজী হয়েই গেলো..আমার এই ঘরের আমাকে আর কোন দরকার নেই..মৃত্যুর মত কঠিন এই সত্যটাকেও মেনে নিতে নিজের শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে..আমি একটু দম নিতে চাই..
বিছানার উপর ফেলে রাখা আবিরের ফোন টা থেকে আমার বাবাকে ফোন দিলাম...
বাবা রিসিভ করার সাথে সাথে গলা টেনে
আমি বললাম--
"বাবা,তুমি এক্ষণি একটু আসো এই বাড়িতে.."
বলেই ফোন কেটে দিলাম..আমি জানি আমার বাবা কি বলবে..কিন্তু এখন উত্তর দেওয়ার সময় নেই..
আমার তো এখন বিদায় নেওয়ার সময়...
বিদায়ের কথা মনে হতেই মনে পড়লো বিয়ের দিন,আমার মা আমাকে বলেছিলো---
"আজ তুমি যে ঘরে যাচ্ছো,সে ঘরটাই তোমার আসল পরিচয়..লাল কাপড়ে ঢুকবে,আর সাদা কাফনে ফিরবে...."
মায়ের কথাটা হয়তো পুরোটা সত্যি হলো না তার অভাগী মেয়ের বেলায়..কিন্তু একেবারেও তো মিথ্যে নয়,আমি তো লাশ হয়েই বের হবো...ঠিক একেবারে জীবন্ত লাশ....
আবির ঘরে ঢুকলো..আমার দিকে তাকালো না..
আমি নীরব অভিমান নিয়েই বললাম,
"আমার এখানে আর কোন প্রয়োজন নেই বোধ হয়...আমি চলে যাচ্ছি..যে মেয়ে তোমার ঘর আলোকিত করতে পারবে,তাকেই ঘরে এনো.."
গল্পঃদ্বিতীয় বিয়ে
(পর্বঃ৩)
লেখাঃআফসানা জামান তুলতুলি