লেখাঃআফসানা জামান তুলতুলি
পরপর তিনবার বাচ্চা নষ্ট হওয়ার পরে ডাক্তার রিপোর্ট দেখে আজ যখন আমাকে বললো,
আমি আর কখনো মা হতে পারবো না...
আমি কথাটা শুনে মূর্তির মতন বসেছিলাম।
একটুও কাঁদিনি আমি..বেশ কয়েক মুহুর্ত চুপ করে থেকে নিজের মনের ভেতর বলে উঠলাম--
"আবিরকে এবার মুক্তি দিতেই হবে আমার..."
ভাবতে ভাবতে ডাক্তার আমাকে একটু ঝাড়ি দিয়ে বলে উঠলো--
"মিসেস আবির,আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন...??"
আমি খেয়াল ফিরিয়ে উত্তর নিলাম,
"জ্বী,আমি শুনেছি.."
"আপনার হাসব্যান্ড সাথে আসেনি কেন জানতে পারি...?"
আমি একটু স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলাম--
"ওর আসলে আজকে অনেক বেশি ব্যস্ততা.একই রিপোর্ট বারবার আনতে আমি একাও তো যথেষ্ট.."
ডাক্তার কিছুক্ষণ আমার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকলো..তারপর নরম গলায় আমাকে সান্ত্বণা দিতে লাগলো--
"শুনুন,এরকম কঠিন সময়ে মানুষ ভেঙে পড়ে খুবই স্বাভাবিক.আপনার কষ্ট আমি বুঝতে পারছি.কিন্তু হাল ছাড়া যাবে না..উপরওয়ালার উপর ভরসা রাখতে হবে..আর একে অপরের সাথে থাকতে হবে..."
আমি চুপ করেই শুনলাম..
ডাক্তারের রুম থেকে বের হবো হবো করে উঠছি,
ডাক্তার আমাকে জিজ্ঞাসা করলো--
"আচ্ছা,মিসেস আবির.. আপনাকে একটা প্রশ্ন করি কিছু মনে না করলে...?"
আমি ঘুরে বললাম--
"জ্বী..বলুন..."
"আচ্ছা..এমন কঠিন খবরে,মানুষকে আমি কান্নায় গড়াগড়ি পর্যন্ত করতে দেখেছি চোখের সামনে।কিন্তু আপনার যে কোন রিএকশন ই দেখলাম না..জানতে পারি,কেন????"
আমি অদ্ভুত এক রকমের হাসি দিলাম আস্তে করে--
"কান্নায় গড়াগড়ি করে যদি আমার দুর্ভাগ্যকে বদলাতে পারতাম,তবে ফল না পাওয়া পর্যন্ত আমি মাথা সোজা করে উঠতাম না..মাটিতেই পড়ে থাকতাম..."
ডাক্তার সাহেব আবারো আমার দিকে তাকালো বিস্মিত চোখে..আমি মুখ ফিরিয়ে বাসার দিকে হাঁটা শুরু করলাম..এলোপাথাড়ি হাঁটছি..পথের ভেতর আবিরের অনেক গুলো কল আসলো..
আমি ধরলাম না....
সন্ধ্যার একটু আগ দিয়ে বাসায় পৌঁছলাম..দরজায় কলিং বেল দিতেই শ্বাশুড়ি মা দরজা খুলে আমাকে জোরে প্রশ্ন করে বসলো---
"কি খবর বউ,ডাক্তার কি বলেছে...?"
আমি একটু দম নিয়ে উত্তর দিলাম,
আমি মা হতে পারবো না কোনদিন.....
শ্বাশুড়ি মা আমার উত্তরে চেহারা একেবারেই কালো করে ফেললো..চোখ দুটো বেশ বড়বড় করে তাকালো আমার দিকে..আমি পরাজিত মানুষের মতন মাথা নিচু করে ঘরের ভেতর ঢুকলাম চুপচাপ...
নিঃশব্দে ঘরের ভেতর ঢুকেই,রিপোর্ট টা বিছানার উপর ফেলে দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা দিয়ে পানির ট্যাপ ছেড়ে ধপ করে বসে পড়লাম মেঝের উপর.....
মনে হলো কেউ জানি আমার বুকের এপাশ থেকে ওপাশ পুরোটাই চিরে দিচ্ছে..তীব্র যন্ত্রণা,ভয়ানক আর্তনাদ হচ্ছে ভেতরে কিন্তু আমি কাঁদতে পারছি না..গত দুইটা বছর প্রতিটা দিন কাঁদতে কাঁদতে বোধ হয়,চোখের পানি শুকিয়ে গেছে...
আমি মা হতে পারবো না কখনো...??
আমার আবিরকে ধরে রাখার আর কিছুই থাকলো না তাহলে...সমস্ত অধিকার আমার ছেড়ে দিতে হবে...???এই কথাগুলো আমাকে মরণ যন্ত্রণা যেন ভোগ করাচ্ছে.....
ওয়াশরুমের দরজায় কড়া নড়ে উঠলো জোরে..
--নীলা,নীলা..দরজা খোল..দরজা খোল..
আবির ডাকছে এভাবে..আমি আবিরের সামনে কিভাবে যাবো..আমার এখনই মরণ হোক না...
আবিরের বারবার দরজা ধাক্কানোর কারণে আমি গায়ে কাপড় পেঁচিয়ে বের হলাম..
মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে থাকলাম আবিরের সামনে...
মাথা একেবারে নিচু করে দাঁড়িয়েই থাকলাম..আবির আমার গায়ে হাত দিয়ে কেমন জানি একটা চিৎকার দিয়ে উঠলো--
"নীলা,তোমার গা পুড়ে যাচ্ছে তো জ্বরে..কি হাল করে রেখোছো নিজের..."?
বলেই আমাকে জড়িয়ে ধরলো..আমি ওকে ধরতে পারলাম না..মনে হচ্ছিলো,আমার শুধু শ্বাস টাই চলছে..আর কোন অনুভুতি নেই..
আবির কান্নার মত করে উঠলো.....
" তুমি এমন করছো কেন,নীলা..?
আমার তোমাকে দেখে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে.."
আমি নিস্তব্ধ,আমার কথা গুলোও হারিয়ে গিয়েছে যেন..হঠাৎ
শুনতে পেলাম শ্বাশুড়ি চেঁচাচ্ছে ওই পাশে--
" পোড়ারমুখী কে আগেই বলেছিলাম,ও আমার ছেলেকে কিছুই দিতে পারবে না।তাও ও আমার ছেলের জীবন থেকে সরলো না..."
এটা শুনেই আবির চেঁচিয়ে উঠলো--
"মা,প্লিজ তুমি চুপ করো..."
বলেই আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো..আমি কিছুক্ষণ এভাবে থেকে মাথা উঁচু করে আবিরের চোখের দিকে দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে গলাটা একটু টেনে বললাম-
"আমি তোমাকে কিছুই দিতে পারিনি আবির..
তোমাকে আমি নিজে হাতে দ্বিতীয় বিয়ে দিতে চাই.."
(পরের অংশ,আজ রাত আট টার পরে)