Socialize

দ্বিতীয় বিয়ে পর্বঃ ৪

গল্পঃদ্বিতীয় বিয়ে
পর্বঃ৪
আবির ঘরে ঢুকলো..আমার দিকে তাকালো না..
আমি নীরব অভিমান নিয়েই বললাম,
"আমার এখানে আর কোন প্রয়োজন নেই বোধ হয়...আমি চলে যাচ্ছি..যে মেয়ে তোমার ঘর আলোকিত করতে পারবে,তাকেই ঘরে এনো.."
আবির কথাটা শুনে চুপ করেই থাকলো..
তারপর বলে উঠলো--
"তুমি যেহেতু জানোই, আমি তোমাকে ছাড়া ভালো থাকবো..সুতরাং আমার কিছুই বলার নেই..."
এই কথাটা শোনার সাথে সাথেই আমার বুকের ভেতর পাহাড় সমান অভিমান জমলো..
কি নিষ্ঠুর, কি নিষ্ঠুর...!
আমাকে একটা বারও ঠেকাতে চাইলো না আবির..??
কথাটা মনে হতেই,
আমার চোখ মুখ ঝাপসা হয়ে আসা শুরু করলো...
চোখের পানি গাল গড়িয়ে পড়লো..
বুকের ভেতর জমা ভীষণ ভারী সে নিঃশ্বাস ফেলতে গিয়ে "উহহহ.." শব্দ করে উঠলাম।।
আবির সাথে সাথে পেছনে ফিরে আমার পাশে বসে পড়লো....
আমি চোখ মুখ শক্ত করে নড়েচড়ে বসলাম..
আর আমার মাথা একেবারে নিচু করে রাখলাম..কারণ আবিরের দিকে তাকালে আমার চোখের পানি আর ঠেকানো যাবে না।।
আমি যে প্রচণ্ড দুর্বল,সেটা প্রকাশ পেয়ে যাবে...
আবির আমার পাশে বসে বোধ হয় আমাকে গভীর মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করছে...
কিছুক্ষণ পরে আবির আমাকে বলে উঠলো--
"জানো নীলা....??
আমার জীবনে এমন সময় আসতে পারে,এমনটা কখনো ভাবিনি..আমি সবার মাঝে তোমাকে সাথে করে নিয়ে ভালো থাকতে চেয়েছিলাম..
বাবা মা এই বাড়িতে বুড়ো হয়েছে,আমিও তোমার হাত ধরে এই বাড়িতেই বুড়ো হতে চেয়েছিলাম...
আচ্ছা..জীবনটা এতো জটিল হয়ে গেলো কেন,বলতে পারো....?"
আমি বোবার মত থাকলাম..কোন উত্তর দিলাম না...
আবির আবার বলতে শুরু করলো--
"আমাকে ছেড়ে তোমার থাকার কষ্ট বোঝানোর জন্য যে আমি তখন চলে গিয়েছিলাম...বিশ্বাস করো,যতটুকু সময় আমি বাইরে ছিলাম,আমার দম বন্ধ লাগছিলো..ছটফট করেছি,কখন বাসায় যাবো..কখন তোমার কাছে আসবো..বাবা যখন আমাকে পথের ভেতরে দেখেই ধমক দিয়ে বললো--
ঘরের বউ পথ চেয়ে আছে,অসহায়টাকে আর কষ্ট দিস না...তখন থেকেই আমি খুশি মনে আমার কদম এগিয়েছিলাম তোমার দিকে যে,বোধ হয় আমাকে দেখলেই তুমি বলে উঠবে---
আমি পারবো না আবির তোমাকে নিজের থেকে দূর করতে..দুজন মিলে দুজনার খেয়াল রেখে বাকিটা জীবন পার করবো..
আমি আশা করেই থাকলাম অথচ তুমি একটা বারও বললে না নীলা...তোমার আর মায়ের মাঝে আমাকে বলি করলে..."
কথাগুলো বলেই আবির আমার মাথায় হাত রাখলো-
তুমি যেখানেই থাকো নীলা,
মনে রেখো আবির তোমাকে নিজের থেকে দূর করেনি,তুমি নিজে আবিরকে পর করেছিলে....
শেষের এই কথা গুলো যেন আমার বুকের ভেতরটাকে চিরে দিচ্ছিলো গভীর করে...
আমি প্রথমবার আমার অশ্রুসিক্ত চোখ জোড়া বন্ধ করে উপরওয়ালার কাছে মনে মনে আর্তনাদ করে উঠলাম---
"হে খোদা..আমাকে মরণ দাও..
আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না..."
আবির আমার দিকে হয়তো আর তাকালো না...
হঠাৎ করে বাসায় কলিং বেল বেজে উঠলো..
আমার বুঝতে বাকি রইলো না,আমার বাবা এসেছে...বাবার উপস্থিতি বুঝতে পেরে আমার কষ্ট গুলো সব লাগামহীন হতে চাইলো...
ছোটবেলার মত কান্না করে করে,বাবার কাছে নালিশ করতে ইচ্ছে করছিলো,আবিরের জন্য আবদার করতে ইচ্ছে করছিলো....
আমার শ্বাশুড়ি এলেন আমার ঘরে তখন...
আমি কেন জানি নড়তে পারলাম না...
তিনি এসে আমার মাথায় আলতো করে হাত দিয়ে বললেন--
"এমন লক্ষী বউ পাওয়া যায় না রে..
তুই তো অনেক করলি এই সংসারে,কটা দিন ঘুরে আয় বাবার বাড়ি থেকে..আবিরের বিয়ের ব্যাপারে ঝামেলা শেষ হলেই আমি তোর জন্য যা যা করার সব করবো.তোকে অনেক দোয়া করি...তুই ভাবিস না বউ.."
আমি মাথা নাড়লাম...
আমি তো এমনিতেই চলে যেতাম...
মা এভাবে আমাকে না বললেও পারতো...
আমি ভাঙা গলায় মাকে শুধু বললাম--
"আমার জন্য দোয়া করতে হবে না মা..
আমার ভাগের দোয়াটুকুও আপনার ছেলের জন্য করবেন..."
কষ্ট,অভিমান এবার আমার আত্মসম্মানের জায়গা নিলো..চোখ মুখ মুছে আমার ঘর থেকে বের হলাম..
বের হওয়ার আগে একবার ভালো করে পুরো ঘরটুকুকে দেখে নিলাম..কষ্ট গুলো বুকের মধ্যে ফুঁসছে..কিন্তু একটুও আর চোখের পানি ফেলবো না..জলদি করে আমি ঘর থেকে বের হলাম..
ডাইনিং রুমে আমার বাবা,শ্বশুর আব্বা,আর শ্বাশুড়ি মা বসেছিলো.আবির নেই..বাবা আমাকে দেখে ছুটে এলো..আমাকে এক ঝলক দেখতেই বাবার চেহারার রং বদলে গেলো..কপালের মাঝে পুরোটাই ভাঁজ পড়লো চিন্তার..আমার নিঃশ্বাস আটকে যাওয়ার উপক্রম.. তবুও আমি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি...
বাবা প্রচণ্ড দরদ মিশিয়ে আমার মুখে হাত দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো---
"বাড়ি যাবি,মা...?"
আমি ছেলে মানুষের মত মাথা নাড়লাম...
বাবা বললো--
--ব্যাগ গুছিয়ে নে..
আমি বললাম--
--কিছুই নিবো না,বাবা..শুধু আমাকে নিয়ে চলো তোমার সাথে....
--কি হয়েছে মা,আমাকে বল..
--সব বলবো বাবা।আগে আমাকে একটু নিঃশ্বাস নিতে দাও..
আমার উত্তর বাবাকে প্রচণ্ড আঘাত দিচ্ছিলো,তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো..
হাত এগিয়ে দিলো বাবা,আমি ধরে নিলাম ছোটবেলার মতন..তারপর আমার হাত টেনে ধরে আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ির কাছে কড়া গলায় বিদায় নিলো--
"আমার মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছি,বেয়াই সাহেব..."
আমার শ্বশুর মাথা নিচু করে রাখলেন..আমি আস্তে আস্তে আব্বার কাছে গেলাম..ভারী কণ্ঠে বললাম-
--আসি,আব্বা...
আব্বার চোখে পানি চলে আসলো..সেও কিছু বলতে পারলো না..
শ্বাশুড়ি মায়ের দিকে তাকিয়ে ইশারায় বোঝালাম
আমি চলেই যাচ্ছি..
তিনি একটু হাসি মুখ রাখলেন।আবির বাড়ি নেই...
হয়তো আবিরের সাথে আমার দেখা হবে না...
আমি বাবার হাত ধরে,দরজার বাইরে চলে গেলাম..
পেছন ফিরে একবারো তাকায়নি...
এক পা করে এগোচ্ছি,আমার নিঃশ্বাস তত ছোট হয়ে আসছে....
পাগলের মত হণ্যে হয়ে আবিরকে খুঁজছিলো চোখজোড়া..কিন্তু কোথাও পেলো না..আমার আবিরকে দেখার অধিকার হারানোর আগে একটা বার ওকে প্রাণ ভরে দেখতে চেয়েছিলাম....
হলো না...গাড়িতে উঠে,জানালার বাইরে মাথা বের করে রাখলাম.চোখে শুধুই আবিরের ছবি..আর সাথে চোখের পানি..বাবা মাঝে মাঝে আমার মাথায় হাত বুলাচ্ছিলো...আমার অবস্থা দেখে হয়তো কথা বলার সাহস করলো না..আমাকে সময় দিচ্ছিলো..
অবশেষে বাসায় পৌঁছলাম।গাড়ি থেকে নেমেই আমি সোজা আমার ঘরে চলে গেলাম।।।
মা আমাকে দেখে আমার পিছু পিছু ছুটে এলো..
আমার অবস্থা দেখে মা ভয়ে চেঁচিয়ে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরলো..আমি জীবন্ত লাশের মত হয়ে থাকলাম..আমাকে বুকের ভেতর করে নিয়ে বিছানায় বসালো..অনেক প্রশ্ন করছিলো বোধ হয়,কিন্তু কোন আওয়াজ আমার পর্যন্ত আসছিলো না..আমি বোধ হয় দুনিয়াতে নেই...
আমি ধুপ করে মায়ের কোলে শুয়ে পড়লাম..অনেক বড় করে নিঃশ্বাস নিলাম...ক্লান্ত চোখের পাতা হুট করেই বন্ধ হয়ে গেলো..
ঘুমের মধ্যেই কাপুনী হচ্ছে প্রচণ্ড শরীরে।।আমি বুঝতে পারছিলাম কেউ খুব শক্ত করে আমাকে চেপে ধরছে কম্বল দিয়ে..তবুও আমি তাকাতে পারছি না...অনেক পরে চোখ খুলেই দেখি
আবির আমার সামনে বসে আছে আমার দিকে একভাবে তাকিয়ে...
আমি বিশ্বাস না করেই ভাবলাম স্বপ্ন..তার মাঝেই জিজ্ঞাসা করলাম--
--তুমি এখানে কেন,আবির??
--তোমার একলার অধিকার নিয়ে শেষবার
তোমার আবিরকে দেখাতে এসেছি..
গল্পঃদ্বিতীয় বিয়ে
পর্বঃ৪
লেখাঃআফসানা জামান তুলতুলি